পরিবেশ প্রতিবেদক
কাহারোল উপজেলার মুকুন্দপুর গ্রামের নিরিবিলি পরিবেশে, ১৭ বছর বয়সী রিফা তার ভাগ্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে নিজ জীবনকে নতুনভাবে গড়ে তুলছে। অল্প বয়সে বিয়ের জন্য তার পরিবার প্রস্তুতি নিয়েছিল—গ্রামের অনেক মেয়ের মতোই তারও একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কিন্তু রিফার গল্পটি অন্যরকম হয়ে ওঠে তার নিজের দৃঢ় সংকল্প এবং স্থানীয় সংগঠন প্রাণ ভোমরা শিশু ফোরামের সাহসী ভূমিকার কারণে।
২০২৪ সালের ১৭ এপ্রিল তারিখে রিফার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। তার বাবা-মা আর্থিক চাপের মুখে মেয়েটির ভবিষ্যৎকে বিবাহের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রিফার মনে ছিল অন্যরকম একটি স্বপ্ন—সে পড়াশোনা করতে চেয়েছিল, তার জীবনকে অন্যরকমভাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিল। এই সংকটময় মুহূর্তে, প্রাণ ভোমরা শিশু ফোরামের সদস্যরা দ্রুততার সাথে উদ্যোগ নেয়। তারা স্থানীয় প্রশাসন এবং হটলাইন নাম্বারে যোগাযোগ করে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রিফার বিয়েটি বন্ধ করতে সক্ষম হয়।
বর্তমানে রিফা দশম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে এবং তার স্বপ্ন একজন স্কুল শিক্ষিকা হওয়ার। "আমি পড়াশোনা করতে চাই। আমার বাবা-মা ভালোবাসেন আমাকে, কিন্তু তারা মনে করেন মেয়েদের জন্য বিয়েই সেরা ভবিষ্যৎ। আমি তাদের ভুল প্রমাণ করতে চাই," রিফা বলেন অশ্রুসিক্ত চোখে।
প্রাণ ভোমরা শিশু ফোরামের এই উদ্যোগ শুধুমাত্র রিফার জীবনকেই বদলে দেয়নি, বরং সমাজের অন্যান্য পরিবারের কাছেও একটি বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। মেয়েদের শিক্ষা যে কিভাবে তাদের জীবনকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে পারে, সেই সত্যটি উপলব্ধি করানোর জন্য সংগঠনটি প্রতিনিয়ত কাজ করছে। তাদের সদস্যরা বিভিন্ন স্কুলে সেমিনার এবং কর্মশালার আয়োজন করছে, যেখানে মেয়েদের শিক্ষার গুরুত্ব, স্বাস্থ্যসেবা, এবং সামাজিক সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়।
২০২৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রাণ ভোমরা শিশু ফোরাম ১৭টি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছে। প্রতিটি সফল পদক্ষেপের পেছনে রয়েছে তাদের সাহসী সদস্যদের নিরলস পরিশ্রম এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের সহযোগিতা। সংগঠনটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে কাজ করছে, যাতে প্রতিটি মেয়ে নিরাপদে ও মুক্তভাবে তার স্বপ্ন পূরণের সুযোগ পায়। বর্তমান সময়ে, বাংলাদেশের প্রতিটি কোণে শিশু বিয়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠছে। বিশেষ করে, প্রাণ ভোমরা শিশু ফোরামের সদস্যরা যেভাবে অসহায় মেয়েদের জন্য সাহসী ভূমিকা পালন করছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। এই ফোরামটি শুধু একটি সংগঠন নয়, বরং এটি একটি সামাজিক আন্দোলন, যা প্রতিটি মেয়ের শিক্ষার অধিকার ও ভবিষ্যতের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কাজ করছে।
মায়ার গল্প: শিক্ষা ও স্বাধীনতার পথে
৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩-এ মায়া নামের ১৩ বছরের একটি মেয়ের বিয়ের পরিকল্পনা ছিল। তার বাবা-মা একথা স্থির করেছিলেন, কিন্তু মায়ার পড়াশোনার ইচ্ছা ছিল প্রবল। প্রাণ ভোমরা শিশু ফোরামের সদস্যরা দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে মেয়েটির বিয়ে বন্ধ করে। বর্তমানে মায়া অষ্টম শ্রেণীতে পড়াশোনা করছে এবং একজন ডাক্তার হতে চায়। তার মত আরও অনেক মেয়ের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হয়েছে, কারণ তারা শিক্ষা ও স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যেতে পারছে।
রিয়া ও দারিদ্র্যের চ্যালেঞ্জ:
২৭ মার্চ ২০২৩-এ রিয়া নামের আরেকটি মেয়ের বিয়ের খবর আসে। পারিবারিক দারিদ্র্যের কারণে তার বাবা-মা বিয়ে ঠিক করেন, কিন্তু রিয়া পড়াশোনা করতে চেয়েছিল। প্রাণ ভোমরা শিশু ফোরাম তার পরিবারের সাথে কথা বলে এবং পড়াশোনায় সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেয়। এর ফলে, রিয়ার বিয়ে বন্ধ হয় এবং সে এখন নবম শ্রেণীতে পড়ছে। এই উদ্যোগটি সামাজিক দারিদ্র্যের মোকাবেলায় একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যেখানে পরিবারগুলো বুঝতে পারছে যে শিক্ষা তাদের মেয়েদের জন্য আরও ভালো ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারে।
নাদিয়া ও মিম: প্রতিবাদের সুর,
৬ জুন ২০২৩-এ নাদিয়া নামের ১৬ বছরের একটি মেয়ের বিয়ে ঠেকানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। তার পেছনে রয়েছে সামাজিক চাপ এবং পারিবারিক প্রত্যাশা। প্রাণ ভোমরা শিশু ফোরামের সদস্যরা পুলিশকে জানিয়ে এই বিয়ে প্রতিরোধ করে, যা প্রমাণ করে যে সংগঠনটি কেবল একটি সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করছে, বরং এটি স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে সমন্বয় করে।
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩-এ মিম নামের ১৫ বছরের একটি মেয়ের বিয়ের কথাও চলে আসে। তার পরিবার তাকে বিয়েতে জোর করছিল, কিন্তু ফোরামের সদস্যরা আবারও পুলিশকে জানিয়ে বিয়ে বন্ধ করে। এটি দেখায় যে, এই সংগঠনটি শুধু মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য নয়, বরং তাদের শিক্ষা ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য কাজ করছে।
মোহনা ও মাহিয়ার সাফল্য
২৩ এপ্রিল ২০২৩-এ মোহনার বিয়ে বন্ধ হয়, এবং বর্তমানে সে দশম শ্রেণীতে পড়ছে। তার শিক্ষা অব্যাহত রাখার সুযোগ তাকে নিজের স্বপ্নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
৫ মে ২০২৩-এ মাহিয়া নামের ১৭ বছরের একটি মেয়ের বিয়ের খবর আসে। তার ভাই সাকিব আল হাসান, যিনি প্রাণ ভোমরা শিশু ফোরামের সভাপতি, সহযোগিতায় বিয়ে প্রতিরোধ করেন। মাহিয়ার গল্পটি আমাদের দেখায় যে, পরিবারে যে সামাজিক চ্যালেঞ্জগুলি রয়েছে, সেগুলো অতিক্রম করার জন্য সমাজের সবাইকে একত্রিত হতে হবে।
সমাজে পরিবর্তন: ফোরামের ভূমিকা
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ কাহারোল এপি'র পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত প্রাণ ভোমরা শিশু ফোরামের কাজ শুধু মেয়েদের বিয়ে বন্ধ করা নয়, বরং এটি সমাজে সচেতনতা তৈরি করছে। তারা সেমিনার, কর্মশালা এবং বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগের মাধ্যমে মেয়েদের শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরছে। ফোরামটি স্থানীয় সম্প্রদায়ের সদস্যদের নিয়ে কাজ করে, যাতে তারা বুঝতে পারে যে শিক্ষা কিভাবে একটি মেয়ের জীবনের গতিপথ পরিবর্তন করতে পারে।
প্রাণ ভোমরা শিশু ফোরামের সভাপতি সাকিব আল হাসান বলেন, "আমরা বিশ্বাস করি প্রতিটি শিশুরই শিক্ষার অধিকার আছে। আমাদের প্রচেষ্টা কেবল বাল্যবিবাহ বন্ধ করা নয়, বরং প্রতিটি মেয়েকে তার স্বপ্নের পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সাহস যোগানো।"
মেয়েদের শিক্ষার অধিকার, স্বাস্থ্যসেবা, এবং সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য এই সংগঠনটি কাজ করে যাচ্ছে। তারা স্থানীয় প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ রেখে একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছে, যেখানে প্রতিটি মেয়ের স্বপ্ন পূরণের সুযোগ থাকবে।